Home DRAFT আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া

by বাংলাস্ফিয়ার
5 comments

সুন্দর মুখোপাধ্যায়

বাংলাস্ফিয়ার—পারস্যের সুফি দার্শনিক-কবি রুমি বলেছেন …. আলো আছে তোমার ভিতরে, যে আলো আলোকিত করে তোমার জীবনকেও, খুঁজে ফেরো সে আলোকে। এই আলোর শতদলের প্রস্ফুটিত হওয়া অনুভব করেছেন আমাদের কবিও। আলো-বাতাস-মাটি সকলকে প্রণাম করে অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।

“আলো, তোমায় নমি/আমার মিলাক অপরাধ।/ ললাটেতে রাখো আমার/ পিতার আশীর্বাদ।/বাতাস, তোমায় নমি,/আমার ঘুচুক অবসাদ,/সকল দেহে বুলায়ে দাও/ পিতার আশীর্বাদ।/মাটি, তোমায় নমি,/আমার মিটুক সর্ব সাধ।/গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো/ পিতার আশীর্বাদ।”

এই যে প্রণত হওয়া, এ ভারি সুন্দর এক অনুভূতি। একা নই, অদ্বিতীয় তো নই-ই, বিশ্বচরাচরে এক বহমানতার অঙ্গ আমি, এ ভাবনা আমাদের মাটির কাছাকাছি রাখে, বিনয় দান করে, প্রাণীজন্মের জন্য কৃতজ্ঞ হতে শেখায় । পূর্বপুরুষ পূর্বনারীদের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, পৃথিবীর প্রতি, ঈশ্বরবিশ্বাসী হলে, ঈশ্বরের প্রতিও। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, প্রধানত আমেরিকায় এবং ইউরোপের কতিপয় দেশে, কৃতজ্ঞতার এই অনুভবকে উদযাপন করা হয় থ্যাঙ্কসগিভিং -এর মধ্য দিয়ে। ধর্মীয় কিছু অনুষঙ্গ থাকলেও বর্তমানে প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবেই পালিত হয় থ্যাঙ্কসগিভিং। ছুটি থাকে ইস্কুল, কলেজ, আপিসে। প্রতিদিনের ছোট ছোট স্বার্থ, হীনতা, ক্লিন্নতা ভুলে,মানুষ মিলিত হন পরস্পরের সঙ্গে। এই হিংসা স্বার্থপরতা ইঁদুরদৌড় আর ভোগবাদ আকীর্ণ পৃথিবী থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের অন্তর্লোকে কৃতজ্ঞতার প্রদীপটিকে প্রজ্জ্বলিত রাখারই আরেক নাম থ্যাঙ্কসগিভিং। এ অবকাশ সম্পর্কের ছিঁড়ে যাওয়া সুতোগুলোকে পরিপাটি রিফু করে নেওয়ার, এ উৎসব চাহিদাসর্বস্ব যাপনের উর্ধ্বে উঠে ‘সব দিবি কে সব দিবি পায়, আয় আয় আয়’ অনুভব করার, ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্বের কাছে ‘সরি’ বলার। থ্যাঙ্কসগিভিং-এর উদযাপনে পুজোর আসনটি হল বাড়ির ডাইনিং টেবিলটি, পুষ্টিকর খাদ্য প্রসাদ, পারিবারিক সম্মেলনে এ পুজো সার্থক হয়ে ওঠে। আত্মীয় বন্ধু প্রিয়জন সবাই মিলে, সব ক্ষোভ অভিমান বিরোধ মতানৈক্য ভুলে ভালোবাসা ও শান্তির মন্ত্রে একাত্ম হয়ে ওঠা, নিরুচ্চার ধন্যবাদ জ্ঞাপন এই মানবজন্মের জন্য, এবং মানুষ হিসেবে যোগ্যতর হয়ে ওঠার অঙ্গীকার নিজের কাছে, এ সবকিছু মিলেই এই পার্বণ।

রুমি বলেন, তোমার সঙ্গে ভেসে চলি স্বপ্ন-সমুদ্দুরে, সুদূর সে কোন দেশে.. যেখানে শান্তি আর সৌন্দর্য পরস্পরের হাত ধরে থাকে, সুখ আর আনন্দে আলো হয়ে থাকে চারদিক। আমাদের প্রেম যেখানে মিশে যায় বিশ্বনিখিলে।

মনে পড়ে যায় গীতাঞ্জলি-র ৮৩ নম্বর কবিতাটি, যেখানে কবি লিখছেন, “কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি/ যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,/ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী/ কোথায় যেতেছি কোন্‌ দেশে সে কোন্‌ দেশে।/ কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে /শোনাব গান একলা তোমার কানে,/ ঢেউয়ের মতন ভাষা- বাঁধন-হারা/আমার সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।”

আমরা যারা জন্ম কর্ম বসবাস ভ্রমণ কোন সূত্রেই মার্কিনী নই,তারা টিভি-সিনেমা-উপন্যাস কিম্বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জেনেছি এই উৎসবটির কথা। তারপর ‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি।

থ্যাঙ্কসগিভিং একটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য অভিধানে যার নিম্নলিখিত অর্থগুলি খুঁজে পেলামঃ

(১) ধন্যবাদ জানানো,কৃতজ্ঞচিত্তে সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি স্বীকার, বিশেষত ঈশ্বরের কাছে।

(২) ঈশ্বরের করুণা ও আশীর্বাদ স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

(৩) একটি বিশেষ দিন, উপরোক্ত কাজগুলির জন্য।

একটাই খটকা লাগে মাঝেমাঝে, খাদ্য পানীয় মেলা খেলার এই উৎসবে ফুরসত মেলে সত্যিকারের অন্তর্যাপনের? তবু, খুব পরিকল্পনামাফিক না হলেও, উদারতা, দাক্ষিণ্য আর যশাকাঙ্ক্ষা রহিত পরোপকারের এক অন্তর্লীন স্রোত যে সমাজে এখনো বহমান এ অনুভূতি আমাদের স্বস্তি দেয়, উদ্বুদ্ধ করে।

পাশাপাশি, আসুন আরেকটি শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি খানিক। ‘থ্যাঙ্কসবিয়িং’। এই ক্রিয়াপদটির আভিধানিক অর্থগুলি হলঃ

(১) দিনের পর দিন স্বার্থান্ধ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় ধরিত্রী মায়ের বুকে সৃষ্টি হয়েছে যে ক্ষত ও ক্ষয়, তার শুশ্রূষা সম্বন্ধে গভীর চিন্তাভাবনা করা।

(২) নিজের অন্তরে মমত্ব, সৌভ্রাতৃত্ব ও শান্তির অন্বেষণ করা।

(৩) সর্বজনীন উদযাপনের মধ্য দিয়ে পরস্পরের চারিত্রিক গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দেওয়া।

(৪) একটা বিশেষ দিনে সক্রিয় কৃতজ্ঞতা- জ্ঞাপন, শুধু এ মানবজনমের জন্য, ঠিক যেমন মাটির বুকে জন্ম হয়েছে বলে ফুল ধন্য মনে করে নিজেকে।

আমাদের কবি বলেছেন “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না”। নিজেকে জানা শুধু নয়, জীবনের এ জটিল কারুকাজে নিজের স্থান ও ভূমিকা বুঝে নেওয়াটাও জরুরি। কোন কোন মানুষের ওপর বৃহৎ ও মহৎ দায়িত্ব চাপায় জীবন, অধিকাংশেরই দিন কাটে আপাত অকিঞ্চিৎকর ছোট ছোট কাজে। যেমনই হোক না কেন, কী করতে হবে, কীভাবে এবং কেনই বা করবো, সেটুকুই সব নয়। জীবনের গলিঘুঁজি প্রশস্ত রাজপথ কিম্বা অথৈ দরিয়া পার হই কেমন ভাবে সেটাই মানুষ হিসেবে সংজ্ঞা নিরূপণ করে আমার। উন্নয়ন আমাকে উদ্ধত করছে কিনা, সংহত চিত্তে সব বিঘ্ন-বিপদের মুখোমুখি হতে পারছি কিনা নির্ভয়ে, সেখানেই এ মনুষ্যজন্মের আসল সার্থকতা। শুধু মানবিক গুণাগুণ নয়, ঐশ্বরিক এক আশীর্বাদও ব্যক্তিজীবনকে চালিত করে নিজস্ব বৃত্তে। সেই অদৃশ্য হাত কখনো বহু বাসনায় ছটফট করা মানুষকে বাঁচায়, কখনো বিপন্ন মানুষকে শক্তি যোগায়। আপাত অদৃশ্যের ভেতরেই রয়ে যায় দৃশ্যমানের বীজ। আকার বদলায়, আত্মা রয়ে যায় অটুট। প্রতিটি মনোরম দৃশ্য, মধুর বাক্য ক্ষণস্থায়ী, সৌন্দর্যবোধ চিরন্তন। ‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে’। যা শাশ্বত, নব নব রূপে তার জন্ম হয় বারংবার। এভাবেও জীবন বয়ে যায় নিজের ছন্দে।

“পুরাতনের হৃদয় টুটে/আপ্‌নি নূতন উঠবে ফুটে,/ জীবনে ফুল ফোটা হলে/ মরণে ফল ফলবে।”

জীবনের ছোট ছোট আপাত-তুচ্ছ গল্পগুলোরও তো স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা জাগে কখনো কখনো। স্তুতি নয়, স্বীকৃতি। কেমন হয়, যদি আজ এ মুহূর্ত থেকেই শুরু করি এই কৃতজ্ঞ স্বীকৃতির অভ্যেসটি? প্রতিদিন, নিয়ম করে, যতক্ষণ না তা আমাদের প্রকৃতির ভেতর প্রোথিত হয়ে যায়?

তোমার বিনয় আমাকে মুগ্ধ করে।

তোমার মত শুধু গাইতে তোমার গান”।

ক্ষমা করার জন্য যে উদারতা লাগে, তা তোমার মধ্যে দেখতে পাই।

তোমার সততার কাছে আমি নতজানু হতে চাই।

তোমার উপস্থিতি আমাকে স্বস্তি দেয়।

আমি অভিভূত তোমার সাহস ও সহনশীলতার পরিচয় পেয়ে।

কেমন হয় বলুন দেখি,এমন সব প্রশংসাবাক্য যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয় আমাদের রোজকার বাচিক আদান-প্রদানে?কখনো পার্থিব, কখনো বা আধ্যাত্মিক স্তরে আদানপ্রদান ঘটে কৃতজ্ঞতার,তবু সেটুকুই সব নয়। নিজেকেও যোগ্য করে তুলতে হয় তার জন্য। ঈশ্বরপ্রদত্ত যে বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষকে মানুষ করে তোলে, তাকেও সদা জাগরূক রাখতে হবে। নিজের জন্য, আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু, সব্বার জন্যও।

আবার, রুমি-র কথায় আসি। লিখেছেন, তুমি সকল ভাবের আকর, সব প্রেমের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তুমিই। তোমারি নাম গাইবো নানা ছলে। “আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান”।

You may also like

5 comments

সুকুমার মিত্র September 12, 2022 - 9:12 am

আপনার নিয়মিত আলোচনা ও লেখার জন্যে আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ ও অন্তরের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

Reply
INDIRA MUKHERJEE September 12, 2022 - 10:36 am

আমি আকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোর দাও নি ,
যা দিয়েছ তারই অযোগ্য ভাবিয়া,
করেও তো কিছু নাও নি।।।

Reply
Smarajit Mukhopadhyay September 12, 2022 - 11:36 am

অসাধারণ

Reply
Nupur Chaudhuri September 12, 2022 - 1:22 pm

পরকে আপন করার নিরন্তর প্রয়াস,
অনিঃশেষ অগ্নিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে নিজেকে ‘ সদাজাগরুক’ রাখার অঙ্গীকার..
অনবদ্য একখানি –‘ মানবিক-আখ্যান’ যেন..
লেখা এবং শেয়ার করার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই — সুন্দর মুখোপাধ্যায় ও সুমন চট্টোপাধ্যায়কে।

Reply
অর্পিতা মিএ। September 13, 2022 - 3:25 pm

অসাধারণ।
তৃপ্তি পেলাম।
কতো সুন্দর ভাবনা, মস্তিষ্ক নয়,হৃদপিণ্ড দিয়ে অনূভুতি
গ্রহণ করা যায়।
ধন্যবাদ আপনাকে।

Reply

Leave a Reply to INDIRA MUKHERJEE Cancel Reply

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.