Home তামাকু সেবনের উপকারিতা

তামাকু সেবনের উপকারিতা

0 comments

নিরানন্দর জার্নাল (১৯)

তামাকু সেবনের উপকারিতা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

ইন্টারনেট সার্ফ করতে করতে একটা ছোট খবরে চোখ আটকে গেল। আজ ৩১ মে নাকি ‘ওয়ার্লড নো টোব্যাকো ডে।’ বুকটা চিনচিন করে উঠল। বিয়োগ ব্যথায়।

আমি বিশ্বাস করি ভালোমানুষ নেশা করবেনই, ছাড়তে হলে নেহাতই বাধ্য হয়ে ছাড়বেন। যেমন ধরুন কেউটে যদি বুকে ছোবল মারে অথবা শ্বাসনালী অবরুদ্ধ হয়ে যায়। আমি নিজেও সেই নেশাতুর ভদ্র সমাজের গর্বিত প্রতিনিধি ছিলাম, বিধি বাম না হওয়া পর্যন্ত। কোনও নেশা করেন না, এমনকী সুপুরির টুকরো পর্যন্ত মুখে দেন না এমন অসংখ্য সজ্জনকেও দেখেছি আমি। তাঁদের কষ্টার্জিত সংযমকে কুর্নিশ জানিয়েও মনে হয়েছে, নশ্বর শরীরটুকুর মেয়াদ সামান্য ক’দিন বাড়ানোর জন্য এঁরা স্বর্গসুখ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছেন মিছিমিছি। দু’পাত্র দিয়ে গলা ভিজিয়ে একটা সিগারেট ধরানোর সুখ মর্ত্যধামে সহজলভ্য নয়।

আমি সিগারেটে প্রথম টান দিই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়। তখন ঝাড়গ্রামের রঘুনাথপুরে আমরা যে পল্লিতে থাকতাম তার চারপাশে বুনো গাছের জঙ্গল ছিল। রাস্তা থেকে একটা আধ-পোড়া সিগারেট কুড়িয়ে, রান্নাঘর থেকে দেশলাই চুরি করে জঙ্গলে ঢুকে সেটা সবে ধরিয়েছি, কানে এল, ‘মা এক্ষুনি এখানে এসে দেখে যাও, সুমন জঙ্গলে ঢুকে বিড়ি ফুঁকছে।’ আমার মতলব আঁচ করতে পেরে দিদি যে সন্তর্পণে আমার পিছু নিয়েছে, আমি বুঝতেই পারিনি। খুক খুক করে কাশি হওয়াটাই ছিল আমার ব্যর্থ অ্যাডভেঞ্চারের একমাত্র প্রাপ্তি।

বকুনি খেয়েছি, চড়-থাপ্পড় হজম করেছি, আমাকে দাবায়ে রাখা যায়নি। বাড়িতে কোনও ধূমপায়ী অতিথি এলে তাঁর সিগারেটের প্যাকেট থেকে এক-আধটা হাপিস করে দেওয়া ছিল আমার বাঁয়ে হাত কা খেল।

প্রথমবারের চরম শিক্ষার পরে আমাকে বমাল গ্রেপ্তার করাটাও আর সহজ ছিল না। কলকাতায় এসে ক্লাস নাইনে ভর্তি হওয়ার পরে বিড়ি ফোঁকা দাঁড়িয়ে গেল নিত্যকার অভ্যাসে, তারপর বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল সিগারেটের সংখ্যা। ফুসফুস বেগড়বাই করতে শুরু করল, ডাক্তার সোজা বাংলায় জানিয়ে দিলেন, ধূমপান না ছাড়লে আমি যেন আর তাঁর চেম্বারে না আসি। তাতেও কর্ণপাত করিনি, ইনহেলার আর সিগারেট চালিয়ে গিয়েছি একসঙ্গে, কখনও সখনও বাড়াবাড়ি হলে লঘু মাত্রায় স্টেরয়েডও খেতে হয়েছে। এই ভাবে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশটি বসন্ত কাটিয়ে দেওয়ার পরে মিশিগানে মেয়ের কাছে যাওয়ার পথে প্রতিজ্ঞা করলাম, না আর সিগারেট খাব না। উইথড্রয়াল সিম্পটমে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হল আমার, সকালে পেট পরিষ্কার হচ্ছে না, রাতে ঘুম আসছে না, মাঝখানের সময়টুকুতে চোখে ক্রমাগত সর্ষে ফুল দেখছি। তবু প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকতে পেরেছিলাম টানা এক বছর।

সংযমের বর্ষপূর্তিতে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল। সংখ্যাতত্ত্ব বলে, ধূমপান ছাড়া সহজ, ছেড়ে থাকা ততটাই কঠিন। ধূমপান ত্যাগের ১০ বছর পরেও ৪০ শতাংশ মানুষ ফের ধূমপান শুরু করে। ডাক্তারবাবুদের মুখে শুনেছি, পার্থিব সব নেশার মধ্যে নিকোটিনের নেশা নাকি সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক, একবার শুরু করলে এই নেশা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ধূমপায়ীকে, আমি চাইলেও নিকোটিন আমাকে ছাড়তে চাইবে না। একবার যাঁরা এই ফাঁদে পা দিয়েছেন তাঁরা সকলেই জানেন এ ব্যথার মর্মকথা।

২০১৯-এর এপ্রিলে ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েও আমি বিড়ি খেয়েছি। ঘর সংলগ্ন বাথরুমে চুপিচুপি। দিন কয়েকের মধ্যেই আমার এই গোপন ধ্যাষ্টামির কথা জানাজানি হয়ে গেল, হাসপাতালে শোরগোল পড়ে গেল, ভাবলাম বুঝি বের-ই করে দেবে। প্রভু জগন্নাথের কৃপায় গুরুদণ্ড এড়ালাম, বন্ধ করে দিলাম ধূমপান।

তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত আমি সুবোধ বালক হয়েই রয়েছি। কোভিড হানা দেওয়ার পরে আমার বেপরোয়া মনোভাবটাও শায়েস্তা হয়েছে। জানতে পেরেছি ফুসফুসের রোগীর কোভিড হলে ইস্ট নাম জপা ছাড়া বিশেষ কিছুই করণীয় থাকে না। মরতে হলে মরব, তাই বলে হাঁফাতে হাঁফাতে? এর চেয়ে বাবা বেঁচে থাকাই ভালো, কী বলেন?

পুনশ্চ- আগামী কালের বিষয়, আমার দেখা ভিআইপি ধূমপায়ী।

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.