Home সুমন নামা নীল সামুরাই

নীল সামুরাই

2 comments

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আকিরো কুরোসাওয়ার ‘ দ্য সেভেন সামুরাই’ দেখেছেন? না দেখে থাকলে অন্যায় করেছেন তবে তার জন্য আক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। সেলুলয়েডের সামুরাইদের বদলে জীবন্ত সামুরাইদের দেখে ফেললাম আমরা সবাই। সাতজন নন, অন্তত তার তিন-গুণ তো হবেই। ফুটবল বিশ্বে ওদের নাম হয়ে গিয়েছে “নীল সামুরাই।’ কাতারের নীল দিগন্তে ফুল আর ভালবাসার আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন ওঁরা। সূর্যোদয়ের দেশ। জাপান।

খেলায় নিজের দেশ জিতলে গাত্র-বর্ণ নির্বিশেষে বাকি সমর্থকেরা কী করেন? উদ্দাম আনন্দে ভাসতে থাকেন, গ্যালারিতে নাচানাচি করেন, সেই রঙীন কার্নিভাল তারপর নেমে আসে রাজপথে, হৈ হুল্লোড় করতে করতেই আনন্দের রাত কখন কাবার হয়ে যায়। আর যদি দৈত্য-বধ সম্ভব হয় তাহলে তো হুল্লোড়ের সুনামি এক রকম অবশ্যম্ভাবী।

অথচ হাফ টাইমে এক গোলে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির গোলের জাল পরপর দু’বার ছিঁড়ে দেওয়ার অলৌকিক দৃশ্য দেখার পরে গ্যালারিতে জাপানি সমর্থকেরা কী করলেন? আবেগ সংযত রেখে সঙ্গে সঙ্গে মনোনিবেশ করলেন কর্তব্যে, নেমে গেলেন ময়লা কুড়িয়ে গ্যালারিকে ফের সাফ-সুতরো করে দেওয়ার কাজে। প্রচারের লোভে নয়, ছবি তোলার জন্যও নয়, স্রেফ স্বভাব বশে। ডিজিটাল বিশ্বে কাতারিরাই সেই অবিশ্বাস্য ছবি ভাইরাল করে দিলেন, গোটা বিশ্ব সেদৃশ্য দেখে মাথা নত করল, হাততালি দিল, বুঝতে পারল জাপানিরাও পৃথিবী নামক গ্রহেরই বাসিন্দা, শুধু জাতে স্বতন্ত্র। কথা কম কাজ বেশির মন্ত্রে দীক্ষিত।

এম এ ক্লাসে আমাদের চিন-জাপানের ইতিহাস পড়তে হয়েছিল। একশ নম্বরের একটি বাধ্যতামূলক পেপার। পড়াতেন যে দুই অধ্যাপক তাঁরা চিনা-জাপানি ভাষার মতো করে ইংরেজি বলতেন বলে এই দুই প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস আমাকে আকৃষ্ট করেনি। সেই অজ্ঞতার বেশ খানিকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম কর্মসূত্রে বারেবারে এই দুই দেশে গিয়ে, চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে, নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। চিন আর জাপান পরস্পরের জাত-দুশ্মন, দু’জনেই দু’জনকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে সমীহ করে। এশিয়ার দুই বিস্ময় দেশ চিন আর জাপান, একজন পরমাণু বিমায় ক্ষত বিক্ষত হয়েও স্ফিফিক্স পাখির মতো ছাইয়ের গাদা থেকে উঠে ফের উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে, অন্যজন কেবল আত্মপ্রত্যয়ের জোরে আজ হোয়াইট হাউসের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। সেখানে ভারত কোথায়? হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বহুকাল আগে যে আক্ষেপের কথা ছন্দোবদ্ধ করেছিলেন আজও তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ‘চীন, ব্রহ্মদেশ, নবীন জাপান, তারাও স্বাধীন তারাও প্রধান/ দসত্ব করিতে করে হেয় জ্ঞান/ ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়।

সামুরাই প্রথা জাপানে উঠে গিয়েছে ‘মেইজি রেস্টারেশনের’ সময়, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। কিন্তু শৌর্য, বীর্য, আনুগত্য আর শিষ্টাচারের প্রতীক হয়ে সামুরাইয়ের স্মৃতি আজও জীবন্ত প্রতিটি জাপানির মনে, যে ঐতিহ্যকে পাথেয় করেই পার্থিব সব প্রতিকূলতাকে তারা জয় করে এসেছে, আজও করছে। তাদের শিষ্ট জাত্যাভিমান শ্বেতাঙ্গ অনেক দেশের মতো উগ্র, উচ্চকিত নয়, অনেক সংযত, শীলিত, নিরুচ্চার। অথচ এই জাত্যাভিমানই জাপানের অগ্রগতির চালিকাশক্তি, সেই কারণেই যে কোনও আপাত দুর্লঙ্ঘ উচ্চতাকে তারা ভয় পায়না, জয় করে না ওঠা পর্যন্ত তারা থামতে জানেনা।

সেই সামুরাই মানসিকতাই আজ প্রতিফলিত হচ্ছে জাপানের ফুটবল শৈলীতে। এই সেদিন পর্যন্ত ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলির মধ্যে জাপান কোনও নম্বরই পেতনা, কোনও দিন পেতে পারে সেটাও অলীক কল্পনা ছিল। জাপানের অভ্যন্তরে ফুটবলের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল বেসবল আর সুমো রেসলিং। জাপানের ফুটবলের ইতিহাস অবশ্যই চড়াই-উতরাইয়ের, এই জোয়ার তো এই ভাঁটা। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে ১৯৯৩ সালে জাপান ফুটবলের উন্নতির জন্য একশ বছরের সুপরিকল্পিত রোড-ম্যাপ সাজিয়ে নিল। শুরু হোল জে-লিগ, ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার তারকা ফুটবলারদের কেউ কেউ আকৃষ্ট হল সেই লিগে খেলতে। ব্রাজিল থেকে জিকো এলেন, ইউরোপ থেকে লিনেকার। অন্যদিকে জাপানের সম্ভাবনাময় তরুন খেলোয়াড়রা ছড়িয়ে পড়লেন ইউরোপের নামজাদা লিগগুলিতে খেলবেন বলে।এই যে জাপান দলটি জার্মানিকে হারিয়ে দিল তারা বেশিরভাগই ক্লাব ফুটবল খেলে বুন্দেসলিগায়, কেউ কেউ বিলেতের প্রিমিয়ার লিগে। প্রতিপক্ষ যত বড়ই হোক, বিনা যুদ্ধে তাকে সূচ্যগ্র মেদিনী জাপান ছেড়ে দেবেনা, লড়ে যাবে আখরি দম তক।

জাপানের কোনও তাড়াহুড়ো নেই। আগামী পাঁচ-সাতটি বিশ্বকাপ নিয়েও তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা স্থির করে রেখেছে নীল সামুরাইদের ফুটবল বিশ্বকাপ জিততে হবে ২০৯৩ সালে। ভাবা যায়?

You may also like

2 comments

Partha Chakraborty November 25, 2022 - 3:38 am

Khub sundar lekha

Reply
Pranay pal November 25, 2022 - 11:15 am

Sundar

Reply

Leave a Reply to Pranay pal Cancel Reply

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.