Home সুমন নামা সিংহ বনাম ইঁদুর

সিংহ বনাম ইঁদুর

5 comments

সুমন চট্টোপাধ্যায়

ইরান-ইংল্যান্ড ম্যাচে শেষ পর্যন্ত জিতল কে? প্রশ্নটি অদ্ভুত শোনালেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।বিশ্বকাপ ফুটবলের স্কোর কার্ডে লেখা থাকবে ইংল্যান্ড ৬-২ গোলে জিতেছে। ইতিহাস এই সংখ্যাতত্ত্বকে আস্তাকুড়ে ফেলে দেবে একদিন। বলবে ইয়ে সব ঝুট হ্যায়, ভুলো মত, ভুলো মত!

কিচ্ছু করতে হবেনা কেবল দু’টি ছবিকে পাশাপাশি রাখুন। পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, লাল টুকটুকে জার্সি পরে চোয়াল শক্ত করে, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ইরানের ফুটবলাররা, স্টেডিয়ামকে নিস্তব্ধ করে রেখে সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে সেদেশের জাতীয় সঙ্গীত। খেলোয়াড়দের চাহনিতে বিপন্নতার ছোঁয়া, অজানা আশঙ্কার ছাপ, তবু সবার ঠোঁট দু’টো যেন বাবা মুস্তাফা সেলাই করে দিয়েছে। সমবেত নীরবতার অস্ত্রে নারীঘাতী, শিশুঘাতী, স্বদেশি মোল্লাতন্ত্রকে বিদ্ধ করল এগারোজন প্রত্যয়ী, বিদ্রোহী, দেশপ্রেমিক, যেন বলতে চাইল, এই মৃত্যু উপত্যকা তাদের দেশ নয়। গোটা বিশ্ব মাথা নত করে অবাক বিস্ময়ে দেখল সেই চোখ-ভেজানো দৃশ্য, তেহরানের মোল্লাকুলের শিরদাঁড়াতেও কি হিমেল স্রোত বয়ে গেলনা?

নির্বাদ প্রতিবাদ

যথাসময়ে সুড়ঙ্গ থেকে লাইন করে ময়দানে নামল ইংল্যান্ড, সবার আগে যথারীতি অধিনায়ক হ্যারি কেন। কিন্তু তাঁর হাতে সেই বাহুবন্ধটি গেল কোথায়? সেই রামধনু রাঙা বাহুবন্ধ, যার পোশাকি নাম হয়েছে ‘ ওয়ান লাভ আর্ম-ব্যান্ড?’ কথা ছিল সমকাম নিষিদ্ধ থাকা কাতারে এলজিবিটি কমিউনিটির পাশে দাঁড়ানো ও গা-জোয়ারি লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদী প্রতীক হবে এই বাহুবন্ধ। কথা ছিল প্রায় সব ইউরোপীয় দেশের অধিনায়কেরাই মাঠে নামবেন এটি পরে, গোটা দুনিয়ার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দু’হাত তুলে স্বাগত আর অভিবাদন জানিয়ে ছিল এমন সাহসী সিদ্ধান্তের। ব্রাহ্ম-মুহূর্তে দেখা গেল ফিফার ধমক শুনে সবাই পাল্টি খেয়েছে, বাঘের বাচ্চারা সব হয়ে গিয়েছে ইঁদুর শাবক। পারসিক শৌর্যের বিপরীতে আমরা দেখতে পেলাম নপুংসক, শ্বেতাঙ্গ কাপুরুষতা। সালাম ইরান, ইউরোপ ওয়াক থুঃ !

যে বাহুবন্ধ মাটিতে লুটলো

আরব ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানকার রাজারা প্রায় সবাই ডজন ডজন ক্রীতদাস রাখত তাদের রাজপ্রাসাদে। তাদের মধ্যে রাজ-অন্তঃপুরে কাজ করার জন্য যারা নির্বাচিত হত তাদের প্রত্যেককে আগে ‘খোজা’ বানিয়ে ফেলা হোত, কেন, প্রাপ্তবয়স্কদের তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। এ তল্লাটে কখনও শ্বেতাঙ্গ খোজা ক্রীতদাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিশ্বকাপের সৌজন্যে এই প্রথম পাওয়া গেল, ফিফা প্রেসিডেন্ট গিয়ানি ইনফান্তিনো।

ফিফার প্রেসিডেন্ট

তিনি আচরণ করে চলেছেন একেবারে কাতার রাজ পরিবারের বাঁধা গোলামের মতো, বিনিময়ে রাজত্ব সহ রাজকন্যেও পাচ্ছেন কিনা, এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। বিশ্বকাপ আয়োজনের ইজারা পাওয়ার পরে কাতারি কর্তারা এই মহোৎসবের ঐতিহ্য মেনে যে সব স্পর্শকাতর বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন, বল মাঠে গড়ানোর ঠিক প্রাক মুহূর্তে দেখা গেল তাঁরা ভোল বদলে ফেলেছেন আর নির্লজ্জের মতো কেশহীন, মেরুদন্ডহীন, ফিফা প্রেসিডেন্ট জো হুজুর বলে সেটাই মেনে নিচ্ছেন। পেনাল্টি স্পটে বলটা দাঁড় করিয়ে কাতারিরা গোটা দুনিয়াকে যস্মিন দেশে যদাচারের মন্ত্র পালনে এক রকম বাধ্য করেছেন, করেই চলেছেন।

কাতারের রাজা

প্রথম উদাহরণ স্টেডিয়ামের ফ্যান-জোনে অ্যালকোহলিক বিয়ারের ওপর শেষ মুহূর্তের নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বকাপের বড় স্পনসর বাডওয়াইজার তার আগে থরে থরে বিয়ারের ক্যান সাজিয়ে বসেছিল ফ্যান-জোনে, তাদের সব আয়োজন মাঠে মারা গেল।নাকের বদলে নরুন দিতে ছাড় দেওয়া হয়েছে নন-অ্যালকোহলিক বিয়ারকে।সে যে কী ভয়ানক বিস্বাদ বস্তু, নিখাদ চিরতার জল, আমি তা জানি। প্রথমটি ঝরণার জল হলে দ্বিতীয়টি রেড়ির তেল। বিয়ার-হীন স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা নিয়ে নানা দেশের সমর্থক প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করছে, ভবী তবু ভুলবার নয়। বরং শুঁড়ির স্বাক্ষী, নন অ্যালকোহলিক বিয়ারে মাতাল ইনফান্তিনোকে সাংবাদিক বৈঠকে বলতে শোনা গেল, তিন ঘন্টা বিয়ার না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবেনা। আমি আপাতত অপেক্ষা করছি জার্মান সমর্থকদের দেখার জন্য, ঘুম থেকে উঠে ঘুমোনো পর্যন্ত যারা বিয়ার পান করে পানীয় জল ভেবে।জার্মানরা ক্ষেপলে ইনফান্তিনোর টাক বাঁচানো খুব মুশকিল ব্যাপার হয়ে যাবে।

সর্বশেষ উদাহরণ, ওয়ান লাভ আর্ম ব্যান্ড পরে খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ফিফার তরফে হুমকি দেওয়া হয়েছে কোনও অধিনায়ক যদি তাদের দেওয়া বাহুবন্ধের বাইরে অন্য কিছু পরেন তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে হলুদ কার্ড দেখানো হবে, প্রয়োজন হলে মাঠ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেও দেওয়া হতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলির ফুটবল ফেডারেশন ফিফার এই খোমেইনি সুলভ ফতোয়া শুনে বেদম ঘাবড়ে গিয়ে যে যার দেশের অধিনায়ককে বার্তা পাঠিয়েছে, বাছা ফিফা যা বলছে তাই কর সোনা, ঝামেলা বাড়াসনি। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না জানার ভঙ্গিতে কাতারিরা বলছে, এই সিদ্ধান্ত তারা নেয়নি, এর দায় সম্পূর্ণ ফিফার।

প্রশ্ন হোল ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার খেলিয়ে দেশগুলি যদি এই ফতোয়া একযোগে অমান্য করত তাহলে ফিফার কী করণীয় ছিল? লবডঙ্কা।বিশ্বকাপের জৌলুষ তার প্রশাসনের মাথায় যারা বসে থাকে তাদের জন্য নয়, যারা মাঠে নামে তাদের জন্য। তারা কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইনফান্তিনোর থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে পারতনা? করেনি কারণ এলজিবিটি কমিউনিটির পাশে দাঁড়ানোর নির্ঘোষটা ছিল কেবল ফোকটে হাততালি পেতে, লিঙ্গ সমতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নয়। নইলে পাড়ার মস্তানের মতো ইনফান্তিনো চমকে দিল আর তাবড় তাবড় দেশের ফুটবল কর্তারা সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লেন? তার মানে একা ইনফান্তিনো নয় গোটা শ্বেতাঙ্গ বিশ্বটাই আসলে খোজাদের বিচরণভূমি।

এবার ইরানি খেলোয়াড়দের দুর্জয় সাহসের কথা ভাবুন। মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল ইরাণের আম জনতা গোড়া থেকেই চায়নি তাদের দেশ কাতারে যাক। তারপরে যখন দেখা গেল দোহার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে খেলোয়াড়দের অনেকে স্বৈরাচারী শাসকের আশীর্বাদ নিতে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, ইরানবাসী তাদের গদ্দার ভিন্ন আর কিছুই মনে করেনি। হতে পারে দেশবাসীর নাড়ির খবর জানা আছে বলে পুরোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই সেদিন ইরানি ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলায়নি।

কিন্তু বেচারাদের তো শ্যাম রাখি না কুল রাখি গোছের অবস্থা, জলে কুমীর তো ডাঙায় বাঘ।দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোর মূল্য যদি এবার তাদের অন্যভাবে চোকাতে হয়? যদি দেশে ফেরা মাত্র তাদের গারদবন্দী করা হয়? যদি নেমে আসে পাশবিক অত্যাচার? ফুটবলের মাঠ থেকে চির-নির্বাসন নিতে হয়? ঠিক কী হতে পারে এখনও অস্পষ্ট। তবে তেহরান থেকে উগ্রবাদী মোল্লারা হুঙ্কার ছাড়তে শুরু করেছেন দেশ ও জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা তারা কিছুতেই মেনে নেবেনা।বাজপাখির মতো তারা নজর করছে পরের ম্যাচেও একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয় কিনা। হোক না হোক ইরানি ফুটবলাররা সাহস ও শৌর্যের যে মরুকেতনচি উড়িয়েছে তার জন্যই ইতিহাস স্মরণ করবে কাতারের বিশ্বকাপকে। করবেই।

You may also like

5 comments

Samiran Roy November 23, 2022 - 12:09 pm

Excellent,
as like as suman da,love you💝

Reply
Dev Baul November 23, 2022 - 12:32 pm

গ্যালারিতে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক হিজাব হীন ইরানী তরুণীর প্রতিবাদ আমার মতে আরও বড় ঘটনা। ফুটবলাররা বেঁচে যেতেও পারেন কারণ তারা প্রচারের পাদপ্রদীপে চলে এসেছেন। কিন্তু এই অনামিকাকে কে বাঁচাবে?

Reply
Rudrani Misra November 23, 2022 - 1:17 pm

আপনার লেখা নিয়ে কিছু বলার সাহস আমার নেই। আমি রোজ শিখতে চেষ্টা করি।😊🙏

Reply
Pradip Kumar Dari November 23, 2022 - 2:21 pm

অনবদ্য বিশ্লেষন।
হায় আমরা ভারতীয় বাঙালিরা এমন ক্লীব কবে থেকে হয়ে গেলাম ভাবতেই অবাক হয়ে যাই। এই বাঙলা কি বৃটিশ খেদানোর সিংহ ভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল ?
ইরাকের বীর খেলোয়াড় রা যেটা করার হিম্মত দেখালো বিদেশে গিয়ে, সেটা আমরা স্বদেশে পারিনা কেনো ??

Reply
Partha Chakraborty November 25, 2022 - 3:06 am

Osadharon lekha

Reply

Leave a Reply to Rudrani Misra Cancel Reply

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.