Home কী খাবে জানি, কী খাওয়া উচিত জানিনা

কী খাবে জানি, কী খাওয়া উচিত জানিনা

by বাংলাস্ফিয়ার
13 comments

সুমন চট্টোপাধ্যায়

কর্মজীবনের চল্লিশটি বছর ধরে কেবল দু’টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে মরেছি।

লোকে কী খায়? যা ছাপছি তা মা-মাসিরা বুঝবেন তো?

এই ‘লোক’ শব্দটি কিঞ্চিৎ গোলমেলে কেননা এখানে লোক বলতে আমরা আম-পাবলিককে বুঝেছি, সংখ্যালঘু, ইদানীং বিলুপ্তপ্রায় বিদ্বজ্জনকে নয়। মা-মাসিরা হলেন এই জনতার সুদীর্ঘ মিছিলের প্রতিনিধি স্বরূপ।

বহুকাল আগে সুরসিক বনফুল খবরের কাগজকে বলেছিলেন,’প্রেম-খুন-গান-মদ-বেশ্যা ও সিনারির ঘন্ট’। প্রমথনাথ বিশী মশাইয়ের মূল্যায়ন ছিল অধ্যাপনা করতে গিয়ে তিনি পন্ডিতদের মূর্খামি দেখেছেন আর মিডিয়ায় দেখেছেন মূর্খদের পান্ডিত্য। অর্থাৎ আমরা হলাম মূর্খ পন্ডিত। একেবারে হক কথা, নতমস্তকে মেনে নিতে আমার কোনও কুন্ঠা নেই।

বাংলা মিডিয়া বরাবর কিন্তু আজকের মতো মূর্খ-পন্ডিতদের স্বর্গরাজ্য ছিলনা। বহু যশস্বী লেখক, সাংবাদিক এবং সম্পাদকের সৌজন্যে, বিশেষ করে আনন্দবাজার চোখে পড়ার মতো উচ্চতায় পৌঁছতে পেরেছিল। দিল্লিতে থাকাকালীন লক্ষ্য করতাম তামিল,তেলুগু এমনকী হিন্দি-ভাষী উচ্চপদস্থ আমলারা নিজেদের মাতৃভাষায় প্রকাশিত কাগজগুলোকে অস্পৃশ্য মনে করতেন, টেবিলে পড়ে থাকলেও ছুঁয়ে দেখতেননা। বিপরীতে সমগোত্রীয় বাঙালি আমলারা বিকেলে আনন্দবাজার পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন।সে সময় সকালের কাগজ দিল্লিতে পৌঁছত বিকেলে, এখন ডিজিটাল যুগে ভৌগলিক দূরত্ব বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।অর্থাৎ মাসিমাদের সঙ্গে মেসোমশায়দের কাছেও কাগজটি একই রকম গ্রহনযোগ্য ছিল। অভীক সরকার বন্ধ ঘরে বেশ গর্ব করে প্রায়শই বলতেন, আনন্দবাজার হোল বাঙালির নিউ ইয়র্ক টাইমস।একেবারেই অসমীচীন তুলনা, শুনে হাসি পেত, সম্পাদকের বুকে দাগা দেবনা বলে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখতাম।

যুগ-বদলের সন্ধিক্ষণে বাংলা খবরের কাগজ কেবল তার কৌলীন্যই হারায়নি, তার অস্তিত্বের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে ডিজিটাল আগ্রাসনের জন্য। কাগজের কাটতি উদ্বেগজনকভাবে নিম্নগামী, বিজ্ঞাপন অপ্রতুল, সে আর অপরিহার্য অভ্যাস নয়।সবচেয়ে দুঃখের কথা স্রেফ অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে বেশ কয়েকটি কাগজকে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয়, বিকিয়ে দিতে হয় সৎ সাংবাদিকতার সব শর্তগুলিকে।বর্তমান রাজ্য সরকার যেভাবে সরকারি বিজ্ঞাপনকে তাদের নিঃশর্ত বশ্যতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, পান থেকে চুন খসলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে কাগজের শ্বাসনালী টিপে ধরে এই অভিজ্ঞতা বামফ্রন্ট আমলে আমাদের হয়নি। খুল্লাম খুল্লা সরকার বিরোধিতা করেও তখন নিয়মিত সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া গিয়েছে, বিরুদ্ধে লিখলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হতে পারে এমন কোনও দুর্ভাবনা সাংবাদিকদের পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখেনি। বাংলাবাজারে এটি গত এক দশকের আমদানি।

আরও দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাটি হোল সকলের অগোচরে কাগজের সঙ্গে তরুন প্রজন্মের পাঠকের প্রায় অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়া।অল্পবয়সীরা খবরের কাগজের ধারই ধারেনা, বেশিরভাগ পাঠকই পঞ্চাশোর্ধ।বাংলা মিডিয়া বলতে এখন কেবল টেলিভিশন চ্যানেলগুলির গলা-ফাটানো আর্তনাদ আর অসংখ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আবর্জনার স্তুপ। যেদিকে তাকাই দেখতে পাই মূর্খ-পন্ডিতের বোলবোলা আর ছুঁচোর কেত্তন।

গঙ্গা দিয়ে এত জল বয়ে যাচ্ছে, ওয়েব ২.০ অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবের চেহারা নিয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে, তামাদি হয়ে যাচ্ছে পুরোনো ধ্যান-ধারণা, ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় হিসেব নিকেশ, অথচ পাবলিক কিন্তু রয়ে গিয়েছে পুরোনো পাবলিক হয়েই।ষাট-সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকে যেমন ছিল এক্কেবারে তাই। হয়ত তার চেয়েও খারাপ। নইলে যৌনতা, ব্যক্তিগত কেচ্ছা, মিথ্যে,অর্ধসত্যর পসরা সাজিয়ে যে সব পোর্টাল চলে তাতে লাখ লাখ লোক এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেন? কিঞ্চিৎ অথবা তার চেয়ে একটু বেশি অনাবৃত নারীর বক্ষ-বিভাজিকা দেখার জন্য এত হ্যাংলামি কেন? মদ্যপানের মতো যৌনতা নিয়ে বঙ্গ-সমাজে ‘ট্যাবু’ অনেককাল উঠে গিয়েছে। মুড়ি-মুরকির মতো যৌনতা ছড়িয়ে আছে হাতের কাছে, খুবই সহজলভ্য হয়ে। ‘সেক্স-স্টার্ভড’, হ্যান্ডেল মারা পাবলিকের তবু উসখুশানি যায়না, অর্থনীতির ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’ বা ‘ল অব ডিমিনিশিং ইউটিলিটির’ পরীক্ষিত সূত্রও ফেল মেরে যায় বাঙালির অবদমিত যৌন-তাড়নার সামনে। যৌনতার এমন সর্বগ্রাসী চাহিদার জন্যই এমন ঢালাও সরবরাহ, কে কতভাবে যৌন সুড়সুড়ানি দিতে পারবে তা নিয়েই অহর্নিশি উদ্দাম প্রতিযোগিতা।

সত্যি কথা বলতে কি আমার গর্বের পেশার এমন নরক-যাত্রা আমাকে যতটা না দুঃখিত করে, ক্রুদ্ধ করে তার কয়েকগুণ বেশি।এই বিরক্তি, ক্রোধ আর বিবমিষার কারণে আমি আমার মতো করে স্রোতের বিপক্ষে একা মাঝি হয়ে আমার ডিঙি নৌকো চালানোর চেষ্টা করছি ওয়েবসাইট ও ইউ টিউব চ্যানেল দু’টোতেই। পরপারের ডাক আসার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই, পাঠক যা খাবে তার বদলে পাঠকের যা খাওয়া উচিত তা পরিবেশন করলে কত দূর এগোনো যায়। সমাজমাধ্যমে যাঁরা বাংলার চালু মিডিয়ার গুষ্টির তুষ্টি করেন, আমি দেখতে চাই তাঁদের মধ্যে কতজন এমন বিকল্প সাংবাদিকতার চেষ্টার প্রতি আকৃষ্ট হন।

আমি চাকরি করিনা, গলায় মালিকের বকলশ নেই, স্বভূমে আমি নিজেই রাজা। এটা যে কতটা তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি দাসত্ব করার সময় তা বুঝতেই পারিনি।ফলে ভিন্ন ধরণের সাংবাদিকতা করে,কচি-কাঁচাদের সঙ্গে নিয়ে আমি অবসর জীবনটাকে সদর্থকভাবে কর্মব্যস্ত করে তুলতে চাই। আমি বিজ্ঞাপনের জন্য কারও সামনে ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়াবনা, না সরকারি না বেসরকারি। অথচ আমার অর্থের প্রয়োজন যা আমি সহৃদয় পাঠকের কাছ থেকে উপার্জন করতে চাই, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নয়, বাংলাস্ফিয়ারকে ধীরে ধীরে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে। এমতো গ্রাহক সম্বল উপার্জনের রাস্তা এখন প্রায় সবাই নিচ্ছে, চাঁদা না দিয়ে ইন্টারনেটে এখন ভাল কোনও কিছু পড়ারই আর উপায় নেই। বাংলা ভাষায় এই মডেলটি প্রয়োগ করার কলজে এতাবৎ কেউ দেখাতে পারেনি, লাখ-লাখ হিট সহসা উবে যাওয়ার ভয়ে। আমি নিঃসম্বল ন্যাংটা, কোনও কিছু হারানোরই আর ভয় নেই, প্রাণটি ছাড়া। ফলে আমি অচিরেই এই মডেল প্রয়োগ করব আমার রাজ্যপাটে, লাখ লাখ যৌন-অবদমিত পাঠকের কোনও প্রয়োজন নেই আমার, যে কয়জন পাশে দাঁড়াবেন তাঁদের নিয়েই আমি সন্তুষ্ট।

স্বীকার করা ভাল এখনও পর্যন্ত এই পরীক্ষায় আমি মোটেই প্রত্যাশিত সাড়া পাইনি, বলতে গেলে ন্যূনতমের চেয়েও কম সাড়া পেয়েছি। দেখেছি কূপমন্ডুক বাঙালি তার পরিচিত বৃত্তের বাইরে কোনও কিছুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেননা। কেষ্ট বনাম ইউক্রেনের মধ্যে পছন্দ করতে বললে দশজনের মধ্যে নয়জনই সম্ভবত বোলপুরের বীর-সন্তানের দিকে ঢলে পড়বেন।পড়ুন।রাতারাতি অভ্যাস বদলে ফেলা যায়না, স্বভাব যায়না মলেও।।তবু স্বধর্মে আমি অবিচল থাকব, জাগ্রত করার চেষ্টা করব পাঠকের কৌতুহল। করবই। আখরি দম তক।

ছবি সৌজন্যে : s3.youthkiawaaz.com

13 comments

Rudrani Misra September 16, 2022 - 11:05 am

অতুলনীয়, অনবদ্য, অসাধারণ কথাগুলো বলেছেন। এখানে কোনও ভাবেই আপনাকে মানে আপনার কথাগুলো কে খন্ডাবার জায়গা নেই। 🙏🙏🙏

Reply
সোমনাথ September 16, 2022 - 4:08 pm

বাঙ্গালী মননের এই যে পরিবর্তন যেখানে দিল্লির বাঙ্গালী আমলারা বিকেলে বাংলা কাগজ পড়তেন আর তার থেকে আপনার ভাষায় আজকের স্রেফ রগরগে যৌনতা এর জন্য দায়ি মধ্য মেধা কিম্বা হয়তো মধ্য মেধাও নয় এক দম নিম্ন মেধা। এবং এটি উভয়ত।তার সাথে আজকাল নেটের দৌলতে আপনি খবর আর ‘খাওয়ানোর’ জায়গায় নেই কারন আপনার মোবাইলে আপনি সেই খবর আরো বিশটা পোর্টালে পাচ্ছেন।তবে খবরের কাগজের মৃত্যুর প্রধান কারণ খবরের কাগজের সমস্ত খবরই বাসি খবর আর তাই ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই।

Reply
Soumik Goswami September 16, 2022 - 11:12 am

অসম্ভব সুন্দর বিশ্লেষণ আজকের গণমাধ্যম নিয়ে। আমরা আপনার লেখনীর গুণমুগ্ধ। আপনি এগিয়ে চলুন। এই বাংলায় এখন তো আর গুণীর স্থান যদিও নেই তবু হাল ছাড়বেন না এই অনুরোধ করি।

Reply
Sukumar Mitra September 16, 2022 - 11:28 am

মুর্খের পাণ্ডিত্য। তবে এই পাণ্ডিত্য থাকতে হলে যুক্তি, তথ্যের জোর না থাকলেও গলার জোর থাকতে হবে। এখন হাঁপানি সাংবাদিকতা বেশ চলছে বাংলায়। পুলিশ, আন্দোলনকারীরা না হাঁপালেও সাংবাদিক হাঁপাচ্ছেন। এটা নাকি হাঁপানি সাংবাদিকতার যুগ।

Reply
Partha Chakraborty September 16, 2022 - 11:46 am

Osadharon lekha

Reply
Aparesh Ray September 16, 2022 - 12:42 pm

Interested to read your story

Reply
Pradip Kumar Majumdar September 16, 2022 - 12:50 pm

এভাবেই লিখে যান, এভাবেই বলে যান। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে সকলকে সমালোচনার সাহস আজ বাংলা মিডিয়া হারিয়ে ফেলেছে।
” আশাহীন দিনে আমি তোমাকে চাই ”
কত Amt. ও কি ভাবে Monthly/
Yearly Subscription দিতে পারি বা A/c No. জানাবেন Please.

Reply
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় September 16, 2022 - 1:31 pm

দারুণ লিখলে। এক সময় এই পেশায় ছিলাম বলে দুঃখিত হই কম। আমার ক্রুব্ধ হওয়ার কোনো জায়গা নেই। যাঁদের দেখে বা লেখা পড়ে এদিকে ঢলে ছিলাম, ভাবি তাদের কথা, যাঁদের এই প্রজন্ম চিনতেই পারল না। কীভাবে বুঝবে, কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ।

Reply
শুভ September 16, 2022 - 1:53 pm

ভীষণ মন কাড়লো কথাগুলো…

Reply
শুভাশিস সৈয়দ September 16, 2022 - 1:54 pm

ভীষণ মন কাড়লো কথাগুলো…

Reply
Debabrata Majumder September 16, 2022 - 4:14 pm

আপনার লেখার একজন সজাগ পাঠক। আগেকার বাধ্যবাধকতা নেই, মনখুলে লিখুন, সোচ্চার হোন, সত্যিই শেষবেলায় কিছ হারাবার নেই। মাঝের অসময়টা ভুলতে চাই। কিছুদিন আগেও টি ভি বিতর্কের বা আলোচনায় আপনার ধার ভারের কাছে সকলকেই ম্লান লাগত, এখনও আপনার উপস্থিতির অভাব বোধ করি। অনেক শুভকামনা, সুস্থ থাকুন। তাকিয়ে রইলাম।

Reply
সৌরভ হাওলাদার September 17, 2022 - 3:54 am

পড়ছি। ভালো কিছু পাওয়ার আশা থাকবে।

তথ্য প্রযুক্তির কারণে, যদি পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, বিজ্ঞাপনও প্রযুক্তির হাত ধরেই আসবে।

Reply
Nupur Chaudhuri September 22, 2022 - 10:20 am

মাথা উঁচু করে একলা চলার অঙ্গীকারকে কুর্নিশ জানাই। তবে অর্থ যেহেতু একটা বড় ব্যাপার সে ব্যাপারে সঠিক ভাবনাচিন্তা জরুরি।
একেবারে শুরুতে ইউটিউব পেজের ডানদিকের নীচে যেখানে –‘ subscribe’ বলে লেখা আছে , সেখানকার bell press করেছিলাম। এখন কথা হল তাই করলেই হবে, না আরও কিছু করণীয় আছে সেটা জানা জরুরি। উত্তরের অপেক্ষায়।🙏

Reply

Leave a Reply to Partha Chakraborty Cancel Reply

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.