Home একদিন যদি খেলা থেমে যায়

একদিন যদি খেলা থেমে যায়

0 comments

নতুন খেলা শুরু হয়

সুকল্প চট্টোপাধ্যায়

ন-কাকা নাকি কোনও এক ওষুধ কোম্পানির চিফ কেমিস্ট ছিলেন। এ পাড়ায় আসা ইস্তক দেখে আসছি এলাকার শিবমন্দিরের চাতাল জুড়ে বাবু হয়ে বসে আছেন। পরনে শতচ্ছিন্ন মলিন গেঞ্জি আর পায়জামা। একমুখ দাড়ি-গোঁফ। পথচলতি মানুষ দেখলেই একটাই প্রশ্ন, হোয়াট টাইম ইজ ইট নাও? যাদের কাছে ঘড়ি নেই তারা ‘জানি না’ টুকু উচ্চারণ করার আগেই চোখে চোখ রেখে ঘড়িবিহীন ন-কাকা সঠিক সময়টা বলে দিতেন। আর বাকিরা কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখার আগেই ঠিকঠাক সময়টা জেনে যেত। আমরা অনেকেই ন-কাকাকে জিজ্ঞেস করে ঘড়ি মিলিয়ে নিতাম ঠিকঠাক চলছে কিনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময় বলার পর ন-কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কথা উচ্চারণ করতেন, বড় দুঃসময় এলো, কেউ জানতে পারে না।

বন্ধুদের মধ্যে কানাকানি শুনতাম অফিসের কয়েকজন সহকর্মী মিলে কিছু খাইয়ে ন-কাকাকে নাকি পাগল করে দিয়েছে। তারপর থেকেই ন-কাকার খেলা ছিল সময়কে ঘিরে। হয়তো মাথার ভিতর একটা ঘড়ি অবিরাম চলতো তার। একটাই প্রশ্ন, হোয়াট টাইম ইজ ইট নাও? আজ মনে হয়, প্রশ্নটা নিজেকেই জিজ্ঞেস করতেন ন-কাকা। সঠিক উত্তর দেওয়া মানে, মাথার ভিতরের ঘড়িটাকে ঠিকঠাক পড়তে পারার নিশ্চিন্তি।
বিকেলে আমরা খেলতে যেতাম রবীন্দ্রভারতীর মাঠে। ন-কাকা তখন মন্দিরের চাতাল ছেড়ে গুটি গুটি মাঠের পাশে বসে আমাদের খেলা দেখতেন। আর পিন্টুকে কাছে পেলেই বায়না করতেন, আমায় খেলতে নিবি? বয়স্ক মানুষ। আমাদের ‘হিংস্র’ ফুটবল খেলায় নিতে সাহস পাইনি আমরা।

ন-কাকার মৃত্যুর পর এ পাড়ায় সময়ের সঙ্গে খেলার আর কেউ রইল না। একদিন সে খেলা থেমে গেল। আর আমাদের ফুটবলে তো তাকে খেলতেই নেওয়া হল না কোনওদিন। সে খেলা থামল না। আর দুঃসময় কখন এলো, আসতেই থাকলো, জানতে পারলাম না।

বেশ কিছু দার্শনিকদের পড়ার পর ন-কাকাদের মতো মানুষের চিন্তার খেলাধূলো গভীর ভাবে লক্ষ্য করি, নোট নিই। আরেকজন এমনই মানুষকে রাস্তায় খুঁজে পেয়েছিলাম এক মেঘলা দিনে। রাস্তার ধারে পানের দোকান থেকে সিগারেট কিনছি। আলখাল্লা পরিহিত অবিন্যস্ত চেহারার একজন হাতে লাঠি নিয়ে ট্র্যাফিক সামলাচ্ছেন যথারীতি। হঠাৎ সূর্য মেঘে ঢেকে যাওয়ায় লাঠি আকাশের দিকে উঁচিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে চিৎকার, তোকে কতবার না বলেছি, আকাশটা রং করার আগে সূর্যটাকে খুলে নিয়ে রং করবি ! এখন হল তো! নাও এ বার বোঝো ঠ্যালা! এ ঠ্যালা সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ থাকলে কী বুঝতেন জানি না, আমি বুঝলাম, এই মানুষ বড় রঙিন খেলোয়ার।
এক খেলা থেমে গেলে অন্য খেলা শুরু হয়।  

সকাল ন’টা। রানাঘাট স্টেশন থেকে ছেড়ে হাফ কিলোমিটার এগিয়েই আধঘণ্টার বেশি থমকে আছে কৃষ্ণনগর লোকাল। বেবাক ভিড়ে একচিলতে বসার জায়গা পেয়ে ধন্য হয়ে বই খুলেছি। কোনও একটা দাবিতে লাইনে কিছু জনগণ বসে পড়েছেন শুনলাম। হঠাৎ দেখলাম দরজা দিয়ে একটা বিরাট বস্তা নিয়ে তিনজন লোক কামরায় ওঠার চেষ্টা করছে। দু’জন কামরার ওপরে লাফিয়ে উঠে বস্তাটা দরজার একপাশে সেট করে দিল। আরেকজন বস্তার পাশে মেঝেয় বসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে লাগল। অন্য দু’জন তাকে ফিসফিসিয়ে কী সব বলে আবার লাফিয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেল। বস্তার বিপুল আকৃতি দেখে কামরার যাত্রীদের চক্ষু চড়কগাছ। দু-একজন কৌতূহল সামলাতে না-পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, কত্তা, যাচ্ছ কোথায়? আর অত বড় বস্তায় আছেটা কী? প্রথমে খানিক কিন্তু কিন্তু করলেও গণ জেরার সামনে লোকটি মুখ খুলতে বাধ্য হল। জানা গেল  রাতে ট্রেনে কাটা পড়েছে এক অজ্ঞাত পরিচয় সদ্যযুবক। লাশ নিয়ে সে কৃষ্ণনগর সদরের মর্গে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। এই শ্রমসাধ্য কাজটা করে দিতে পারলে তার সামান্য কিছু নগদ প্রাপ্তি ঘটবে। সারা কামরায় এ খবর রটি গেল দাবানলের মতো। বেশিরভাগ যাত্রী প্রবল আপত্তি তুলে বললেন, জ্যান্ত মানুষের মাঝখানে লাশ কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। কিন্তু বাহকের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অসহায় চেহারার দিকে চেয়ে অন্য যাত্রীরা বলল, যাক না। লাশ তো আর বসার জায়গা চাইছে না। শোরগোলের মধ্যেই ট্রেনের চাকা নড়ে উঠল।

বস্তাবাহকের কাছে একজন জানতে চাইল কখন ঘটেছে ঘটনাটা। জানা গেল, ভোররাতের দিকে ছেলেটি কাটা পড়েছে। স্থানীয় কেউ মৃতদেহ শনাক্ত করতে আসেনি। তাই মর্গে চালান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এরপর ভিড়ের মধ্যে থেকে কানে আসতে শুরু করল নানা সংলাপের তুবড়ি।
-ছেলেটা নিশ্চয়ই নেশা করতো। নেশার ঘোরেই লাইনে শুয়ে পড়েছিল
– বড়লোক বাপের ছেলে হবে, বুইলেন না। নিশ্চয়ই প্রেম-ট্রেম ঘটিত ব্যাপার। বাড়িতে রাজি হচ্ছিল না।

-বাড়িতে রাজি হচ্ছিল না বলেই তুই সুইসাইড করবি! আশ্চর্য! যে বাপ-মা তোকে মানুষ করল, তাদের কথা একবারও ভেবে দেখবি না। দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে একটা। এইসব সন্তান থাকার চাইতে না থাকাই ভালো।

-হয়তো পরীক্ষায় ফেল-টেল করেছে। আরে আজকালকার ছেলে মশায়। লেখা-পড়ার নাম নেই। ফেল করলেই কলেজে অশান্তি, বোমাবাজি। আর বাড়িতে এসে বাপ-মায়ের ওপর হম্বি-তম্বি। আরে গার্জিয়ান একটু শাসন করতে পারবে না।
– ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে গিয়েছিল মশাই। আজকাল ভদ্রঘরের ছেলেরাও স্মাগলারের দলে নাম লেখাচ্ছে; শোনেননি! হয়তো পুলিশের তাড়া খেয়েই…
সংলাপের ভিড়ের ভিতর যুবকটির লাশবন্দি বস্তা ট্রেনের দুলকিতে  দুলছে। বস্তাবাহক লোকটির কানে কোনও কথা যাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। সে আনমনে বিড়ি টানছে।
ছেলেটির খেলা থেমে গেছে ভোর রাতে। তার প্রিয়জনেরা হয়তো খবর পাননি এখনও। আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা, তাও নিশ্চিত নয়। তবু নতুন খেলা শুরু হয়েছে তাকে ঘিরেই। তার পরিচয় ও মৃত্যুর পটভূমি পালটে পাল্টে যাচ্ছে মুহূর্মুহূ। একটি ভিড়  একটি মৃত্যুকে নিয়ে খেলছে।

একদিন যদি খেলা থেমে যায়, নতুন খেলা শুরু হয়।

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.