Home আমি ও অবনীরা

আমি ও অবনীরা

0 comments

সুমন চট্টোপাধ্যায়

দুয়ার এঁটে দাঁড়িয়ে আছে পাড়া/ কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া/ অবনী বাড়ি আছো?
ওঁদের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে আমারও ইচ্ছে করে। হ্যাঁ ওই মধ্যরাতেই। অবনীদের জাগিয়ে তুলে জানতে ইচ্ছে করে, দিনের বেলায় জেগে ঘুমাও, রাতে তো জাগতেই পারো, পারো না?

জানতে ইচ্ছে করে রাতে তারা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, না মটকা মেরে পড়ে থাকে। সারারাত আসলে ছটফটই করে কাল সকালে আবার জেগে ঘুমোনোর তাড়নায়? 

জানতে ইচ্ছে করে, দিনে অথবা রাতে কোনও এক সময় ওঁরা আয়নার সামনে দাঁড়ান কি না। দাঁড়ালে যে প্রতিবিম্বটি দেখেন, তাকে চিনতে পারেন তো? যেমনটি তাঁকে দেখার কথা ছিল তেমনই দেখায়, নাকি অন্য রকম? গাত্র-চর্ম যে গন্ডারের চেয়েও পুরু হয়ে গেছে, তা কি বোঝা যায়? বাপ-মায়ের দেওয়া পদ যুগলের পিছনে আরও যে দু’টি পা গজিয়েছে, আরশিতে কি তা দেখা যায়? গেলে সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে কি লজ্জায় কান দুটো লাল হয়ে ওঠে? নাকি হঠাৎ মনে পড়ে, সে দু’টো তো কবেই চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গিয়েছে, মাথার পাশে ও দু’টো নকল কান? বন্ধ ঘরে একলা আরশির সামনে দাঁড়াতে কি ভয় ভয় করে? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে জল বসন্তের মতো? হঠাৎ তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়? কোনও অশরীরী শক্তি এসে টুঁটিটা চেপে ধরেছে বলে মনে হয়? আর তখনই কি মেহের আলির মতো বলে উঠতে ইচ্ছে করে — তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়?

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, বুদ্ধি আর বিবেকের টানাপোড়েন তাঁদের যন্ত্রণাবিদ্ধ করে কি না। হৃদয় যা বলে, মস্তিষ্কে তা ভুল করেও প্রবেশ করে না কেন? এমন বোবা-বিবেক নিয়ে বাকি সকলের চোখে ফাঁকি দেওয়া গেলেও নিজের কাছে কি নিজেকে ফাঁকি দেওয়া যায়? দেওয়া সম্ভব? বব ডিলানের সেই ভুবনজয়ী গানটিকে একটু নিজের মতো করে সাজিয়ে জানতে চাইব — সহ্যের সীমা কোন অসীম-বিন্দুতে পৌঁছলে তবে তাঁদের বিবেক জাগ্রত হবে। নাকি ঋণ আর দক্ষিণার নাগপাশে তাঁরা এমন ভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন যে শরীরটা পৌঁছনোর অনেক আগেই তাঁরা বিবেককে চিতায় তুলে দিয়েছেন, তাও অনেক কাল হয়ে গেল? বিধাতার অভিশাপে দেবী বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত মরা বিবেককে তাঁরা বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন না, কিছুতেই নয়? ততদিন, যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে যায়?

অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের মড়া কান্নার মতো অবনীদের জন্যও আমার মন কেমন করে। কেন না এঁদের অনেকের সঙ্গে আমি একদা খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি, হই হুল্লোড় করেছি, রাত কাবার করে গপ্পো-গুজব, পান-ধ্যানও চলেছে, পরস্পরকে স্বজন বলেই মেনেছি। একটি বড় পরিবর্তনের সঙ্গে এঁদেরও এমন নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, কখনও ভাবিনি। এখনও ভেবে কষ্ট পাই। ক্ষমতার বগলের সেঁদো গন্ধে এঁদের এমন নেশা ধরে যাবে, রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে নিয়ে গিয়েও নেশা ছাড়ানো যাবে না, এই মর্মান্তিক পরিণতি আমার মতো মুখ্যুসুখ্যু মানুষের বোধগম্যই হয়নি কখনও। মাইরি বলছি হয়নি।

এঁরা রোয়াকে বসে বেপাড়ার মেয়ে দেখলে সিটি মারা অপগন্ডের দল নন। এঁরা সবাই সুশিক্ষিত, প্রতিভাবান, নিজের নিজের ক্ষেত্রে যশস্বী। ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও এঁরা ভালো, চোরচোট্টা নন, কেউ কেউ খুব পরোপকারী, বেশ নরম-সরম স্বভাবের। এঁরা প্রত্যেকেই স্বীয় পরিচয়ে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত, সবাই এঁদের চেনেন। ক্ষমতাবান হওয়া অথবা ক্ষমতার পাশে পাশে থেকে গন্ধশোঁকা এঁদের মারণ-ব্যাধি, এইডসের মতো এই ব্যাধিটিরও নিরাময় আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, এটাই পরিতাপের।

মাঝরাতে এই পরিচিত অবনীদের বাড়ির দরজায় আমি টোকা মারতেই পারি। মারলে দরজা খুলবে, অসময়ে আপ্যায়নও জুটতে পারে কপালে থাকলে। গেলেও আমি এঁদের মঙ্গল সাধন করতে পারব না, আমার হিতোপদেশ এঁরা গ্রাহ্যই করবেন না। বরং উল্টে আমাকেই পরামর্শ দেবেন, ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করে ওঁদের দল-ভারী করতে। আমার কথা ওঁরা শুনবেন না, ওঁদের কথা আমি শুনব না। তা হলে?

তা হলে আবার কী, ঘচাং ফু। যেতে পারলেই যেতে হবে নাকি? হড়পা বান এলে ওঁরা যখন তলিয়ে যাওয়ার ভয় পাবেন, তখন যাব, আলবাৎ যাব। আপাতত কেবল শব্দতরঙ্গে একটি সতর্কবাণীই ভাসিয়ে দিই — অবনীরা সাবধানে থাকবেন!

Leave a Comment

Description. online stores, news, magazine or review sites.

Edtior's Picks

Latest Articles

All Right Reserved.